দাবা খেলার গুটির নাম: নিয়ম, ইতিহাস এবং দাবার কয়েকটি গোপন চাল

লোকমুখে বলা হয়ে থাকে বুদ্ধিমত্তা এবং রাজা-বাদশাদের খেলা হলো দাবা খেলাবিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন খেলা হলো দাবা। রাজনৈতিক এবং একে অপরের বিরুদ্ধে কৌশল খাটানোর জন্য এই দাবা খেলা বেশ জনপ্রিয় ছিলো। কথিত আছে, দাবার চালের সাথে শত্রুর দূর্বল দিক এবং শত্রুকে ঘায়েল করার কৌশল আয়ত্ত হয়ে যেতো। অনেকে দাবা খেলা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে আগ্রহ প্রকাশ করে আমাদেরকে এ বিষয়ে লেখার জন্য অনুরোধ করে থাকেন। তাদের কথা মাথায় রেখে আজকের আর্টিকেলে দাবা খেলার গুটির নাম: নিয়ম, ইতিহাস এবং দাবার কয়েকটি গোপন চাল সম্পর্কে আলোচনা করবো। ধৈর্য্য সহকারে পুরো আর্টিকেলটি পড়ুন।

দাবা খেলার সূচনা বা ইতিহাস

দাবা খেলার ইতিহাস জানতে গেলে একটা ধোঁয়াশা তৈরি হয়। অর্থাৎ দাবা খেলার ইতিহাস সম্পর্কে তেমন কেউ জানেনা! কিন্তু ইতিহাসবিদরা এতটুকু ধারণা করেন যে, ১৫০০ বছর পূর্বে খ্রীস্টপূর্ব ৩ হাজার সালে ভারতবর্ষে দাবার মতো আরেকটি খেলার প্রচলন ছিলো, সেই খেলার নাম ‘শতরন্জ’। অনেকে মনে করেন এই ভারতবর্ষের শতরঞ্জ খেলা থেকেই দাবা খেলার সূচনা হয়েছে

আবার কোনো কোনো ইতিহাসবিদরা মনে করে থাকে, পারস্য কিংবা চীন থেকে এ দাবার প্রচলন শুরু হয়েছে। আসল ইতিহাস কেউ সঠিকভাবে তুলে ধরতে পারেনি! তবে পরবর্তীতে ১৫/১৬ শতাব্দীতে ইউরোপীয়দের হাত ধরে আধুনিক দাবা খেলার সূচনা হয়। বর্তমানে আমরা যে দাবা খেলে থাকি সেটা ইউরোপীয় দেশ থেকে উৎপত্তি হয়েছে।

দাবা খেলার গুটির নাম এবং ভূমিকা

দাবা খেলার কোর্ট বা বোর্ডে সর্বমোট ৬৪টি সারি সারি ঘর থাকে। এবং সে ঘরগুলোর দুইজন খেলোয়াড়দের পাশের দুই সারিতে সাদা এবং কালো গুটি মিলিয়ে ১৬টি করে গুটি থাকে। অর্থাৎ ১৬টি করে দুইপাশ মিলিয়ে মোট ৩২টি গুটি থাকে। নিম্নে দাবা খেলার গুটির নাম এবং তাদের মান বা ভুমিকা তুলে ধরা হলো:

রাজা (King)

রাজা (King) হচ্ছে দাবা কোর্টের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গুটি। প্রতিপক্ষ যদি কোনোভাবে রাজাকে খেয়ে ফেলতে পারে তাহলে খেলা শেষ বা গেইম হয়ে যাবে। রাজা তার চতুর দিকে বা চারপাশে থাকা যে কোনো ঘরে এক ঘর করে চলতে পারে। তবে কোনো কোর্ট যদি শত্রুর হামলায় থাকে তাহলে রাজা সেখানে যেতে পারে না।

রানী (Queen)

রানী (Queen) হলো দাবা কোর্টের সবচেয়ে শক্তিশালী গুটি। অনেকে রাজা আর রানীকে একটু গুলিয়ে ফেলেন! আরেকটু ক্লিয়ার করি; রাজা হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গুটি, আর রানী হলো শক্তিশালী গুটি। রানী তার চারপাশে ফাঁকা থাকা যে কোনো ঘরে অনায়াসে যেতে পারে। আড়াআড়ি, কোনাকুনি এক কথায় ইচ্ছা মতো যে কোনো ঘরে রানী যেতে পারে।

হাতি (Rook)

হাতি (Rook) হলো দাবা কোর্টের প্রতিরক্ষা এবং আক্রমণের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে থাকে। বেশিরভাগ আক্রমণগুলো হাতির মাধ্যমে করা হয়ে থাকে, আবার প্রতিরক্ষা ও হাতির মাধ্যমে বেশিরভাগ সময়ে হয়ে থাকে। হাতি দাবা কোর্টের একদম কোনার ঘরগুলোতে অবস্থান করে থাকে। হাতি সব ঘরে যেতে পারে, তবে সেটা সোজাসুজিভাবে। আড়াআড়িভাবে হাতি চলতে পারে না!

ঘোড়া (Knight)

ঘোড়া (Knight) ঘোড়া দাবা কোর্টের সবচে চতুর এবং কৌশলে চলা গুটি। প্রতিপক্ষের নজর ফাঁকি দিয়ে কৌশল খাটানোর ব্যাপারে ঘোড়া একদম অভিজ্ঞ গুটি। দাবা কোর্টের মধ্যে ঘোড়া একমাত্র গুটি যা এল পদ্ধতিতে চলে, অর্থাৎ দুই ঘর সোজা এবং এক ঘর পাশে যেতে পারে ঘোড়া। এমনকি ঘোড়ার সামনে অন্য কোনো গুটি থাকলেও সে গুটির উপর দিয়ে লাফিয়ে ঘোড় তার ইচ্ছে মতো ঘরে বসতে পারে।

হাতি (Bishop)

হাতি (Bishop) এই হাতিটা দাবা কোর্টের শুধুমাত্র খেলার চাল বা সৈনিক হিসেবে কাজ করে থাকে। হাতিটা শুধুমাত্র কোনাকুনিভাবে চলতে পারে। এবং দাবা কোর্টের নির্দিষ্ট কালারের ঘর অর্থাৎ সাদাতে থাকলে সাদাতে যেতে পারে, কালোতে থাকলে কালো। নিজস্ব কালার ছাড়া অন্য কোথাও যেতে পারে না!

বোড়ে (Pawn)

বোড়ে (Pawn) এই বোড়ে গুটিটা দাবা কোর্টের সবচেয়ে দূর্বল গুটি। দেখতেও খুবই ছোট দেখা যায়! তবে নিজের বুদ্ধি দিয়ে যদি সঠিক সময়ে সঠিকভাবে বোড়েকে চাল দেওয়া যায়, তাহলে প্রতিপক্ষের জন্য এটা ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে! বোড়ে তার সামনের ঘরে এক ঘর চলতে পারে। তবে সর্বপ্রথম চালে বোড়ে দুই ঘর যেতে পারে। বোড়ে গুটিটা চলতে চলতে প্রতিপক্ষের ঘরের শেষ লাইনে পৌছুতে পারলে বোড়ে অন্য শক্তিশালী গুটি রানী বা যে কোনো গুটিতে পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে।

দাবা খেলার নিয়মাবলী

দাবা খেলার নিয়মাবলী সম্পর্কে আমরা হয়তো সঠিক জ্ঞান রাখিনা! এজন্য এ অধ্যায়ে দাবা খেলার নিয়মাবলী সম্পর্কে আলোচনা করবো। নিম্নে নিয়মাবলী তুলে ধরা হলো:

  • রাজা যদি প্রতিপক্ষের জালে আটকা পড়ে যায়, তাহলে নিজের সমস্ত গুটি থাকলেও খেলা আর চালিয়ে যাওয়া যায় না। তখন গেইম শেষ ধরা হয়।
  • যদি দুই পক্ষ অনেক সময় ধরে হাড্ডাহাড্ডি লড়া চালিয়েও কেউ কাউকে পরাজিত না করতে পারে, তাহলে তখন সেটা ড্র হিসেবে বিবেচিত হয়।
  • আন্তর্জাতিক পর্যায়ের দাবা খেলার জন্য নির্দিষ্ট নিয়ম বা সময় থাকে। তবে ফ্রেন্ডলি দাবা ম্যাচগুলো গেইম শেষ না হওয়া অবধি খেলা হয়ে থাকে।
  • প্রতিপক্ষ বা নিজে যদি কোনো গুটিতে হাত দেয়, তাহলে সেই গুটিকেই সরাতে হবে! এক গুটিতে হাত দিয়ে অন্য কোনো গুটি সরানো নিয়মবহির্ভূত কাজ।
  • সময় নির্ধারিত থাকলে সেটা শুধুমাত্র ম্যাচের জন্য নির্ধারিত। চাল দেওয়ার জন্য কোনো সময় নির্ধারিত থাকে না। দাবা চালগুলো সময় নিয়ে এবং বুঝেশুনে দিতে হয়।
  • আন্তর্জাতিক দাবা খেলায় খেলোয়াড়দের সাথে একটা টাইপিং ঘড়ি থাকে। একটা চাল দেওয়ার পরে বোতাম চাপ দিয়ে প্রতিপক্ষকে চাল দেওয়ার জন্য অনুরোধ করে দিতে হয়।
  • বোড়ে গুটিটা সবসময় সামনেই আগাতে পারবে, কখনো পিছনে আসতে পারবে না।
  • নৌকা গুটিটা তার ইচ্ছেমতো যে কোনো ঘরে যাওয়ার পাশাপাশি, মাঝেমধ্যে রাজার সাথে তার ঘরকে পরিবর্তন করে প্রতিপক্ষকে বিপদে ফেলতে পারে। এ ধরনের নিয়মের নাম হলো ‘ক্যাসলিং’।
দাবা খেলার গুটির নাম: নিয়ম, ইতিহাস এবং দাবার কয়েকটি গোপন চাল
দাবা খেলা

দাবার গোপন চাল ও কৌশল সম্পর্কে একটু জেনে নিন

দাবা খেলা শুধুমাত্র একটি বিনোদনের খেলা নয়; এটি রাজনৈতিক বা শত্রুর বিরুদ্ধে কঠিন পদক্ষেপ এবং কৌশল খাটানোর জন্য বেশ কার্যকরী। পাশাপাশি শত্রুর হাত থেকে বাঁচতেও দাবা বিভিন্ন চাল বিভিন্ন পথ বের করো দিতে পারে। দাবা খেলা সম্পর্কে আমরা কমবেশি জানলেও দাবা খেলার কয়েকটি গোপন চাল থাকে, সে বিষয়ে আমরা হয়তো তেমন জানিনা। চলুন তাহলে গোপন সেই চাল বা কৌশল সম্পর্কে জেনে আসি।

গোপন সেই চাল বা কৌশল

  • যদি আপনি আপনার একটি গুটি দিয়ে প্রতিপক্ষের একাধিক গুটি বা শত্রুকে আক্রমণ করতে চান, সে সময়ে আপনাকে খুবই কৌশলে ঘোড়া দিয়ে চাল দিতে হবে। ঘোড়া এমন একটা গুটি যা প্রতিপক্ষের সমস্ত গুটির আশেপাশে এমনকি উপর দিয়েও যেতে পারে। সুতরাং এক গুটি দিয়ে অধিক আক্রমণের জন্য ঘোড়া সবচেয়ে ভালো পদক্ষেপ।
  • প্রতিপক্ষকে আক্রমনের সময়ে এমনভাবে আক্রমণ করা উচিত; যেনো সে যদি তার ঘর ছেড়ে না সরে যায় তাহলে সে তো ক্ষতিগ্রস্ত হবেই, সাথে তার পেছনে থাকা অন্যান্য গুটি গুলো ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এভাবে আক্রমণ করতে পারলে প্রতিপক্ষ হিমশিম খেয়ে ভুল চাল দিতে আত্মসমর্পণ বা পিছুটান নিবে। এ ধরনের চালকে বলা হয়ে থাকে পিন চাল।
  • উপরের বলা কৌশলের বিপরীতে আরেকটি চাল আছে, সেটা হলো; বুঝেশুনে প্রতিপক্ষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গুটিকে আক্রমণ করা, যার ফলে গুরুত্বপূর্ণ গুটির সাথে থাকা সমস্ত গুটি বা সৈন্য ও যেনো ধরা পড়ে যায়। এ ধরনের চালকে বলা হয়ে তাকে স্কিউয়ার।
  • অনেক সময়ে জায়গা বুঝে নিজের গুটিকে প্রতিপক্ষকে দিয়ে খাইয়ে দিয়ে প্রতিপক্ষকে এমন একটি ঘরে নিয়ে চলে আসা, যে ঘরে আসলে গুটির আনন্দের চেয়েও বেশি বিপদে পড়বে প্রতিপক্ষ বা শত্রুপক্ষ। নিজের দূর্বল গুটিকে ইচ্ছাকৃতভাবে হারিয়ে প্রতিপক্ষকে বিপদে ফেলতে পারার এমন খেলা বা কৌশলকে ত্যাগ করা বলা হয়ে থাকে।
দাবা খেলার সবচেয়ে শক্তিশালী গুটি কোনটি?

বিশ্বের জনপ্রিয় এবং প্রাচীন খেলা হলো দাবা খেলা। বর্তমানে আধুনিক সমাজের মানুষেরা ও এ দাবা নিয়ে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। দাবা খেলার মধ্যে অসংখ্য গুটি রয়েছে, তারমধ্যে মন্ত্রী (♛) হলো দাবা খেলার সবচেয়ে শক্তিশালী গুটি

আরো পড়ুন: টেনিস খেলার নিয়ম: ইতিহাস, মাঠের মাপ এবং খেলার উপকারিতা

তো এই ছিলো দাবা খেলার গুটির নাম: নিয়ম, ইতিহাস এবং দাবার কয়েকটি গোপন চাল সম্পর্কে বিষদ আলোচনা। আশা করি আপনারা সঠিক তথ্য পেয়েছেন। এই আলোচনার বাহিরে আপনাদের আরো কিছু জানার থাকলে কমেন্টের মাধ্যমে আমাদেরকে তা জানাতে পারেন।

আমাদের সাথে থাকুন- Sports Buzz BD

1 thought on “দাবা খেলার গুটির নাম: নিয়ম, ইতিহাস এবং দাবার কয়েকটি গোপন চাল”

Leave a Comment